স্যাটেলাইট

নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রেরণ করা বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে গৌরবজনক অধ্যায়ে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই গৌরব ছুঁতে পারেনি দেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রের হৃদয়। কারণ, তাদের মনপ্রাণ পড়ে আছে করাচি-রাওয়ালপিন্ডিতে। বাংলাদেশের কোনো গৌরবজনক সাফল্যে তাদের আনন্দ হয় না, উদ্বেলিত হয় না হৃদয়। তাছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জড়িয়ে আছে, এমন সব কিছুতেই তাদের গাত্রদাহ।

এরই ধারাবাহিকতায় মহাকাশে পাঠানো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে দেশের শীর্ষ এবং বিদেশি মালিকানাধীন কয়েকটি বাংলাভাষী সংবাদমাধ্যম শুরু করেছে জঘন্য মিথ্যাচার। অপপ্রচার চলছে- বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে নাকি বাংলাদেশ কোনো আয় করতে পারেনি এখনও! আসলেই কি তাই? আসুন সত্যটা জানা যাক।

চতুর্থ বছর সম্প্ন্ন করল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। উৎক্ষেপণের মাত্র দেড় বছরের মাথায় আয়ের খাতায় নাম লেখায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট–১। গত ২০১৯ সালের ১লা অক্টোবর এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচার শুরু হয়।

প্রতিবছর এই স্যাটেলাইটটি থেকে আয় হচ্ছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। ভবিষ্যতে এই আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। এছাড়া সেবার পরিধিও বাড়বে কয়েকগুণ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্বয়ং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ। তিনি জানান, বর্তমানে স্যাটেলাইট-১ পরিচালনার খরচ সরকারের বহন করতে হচ্ছে না, বরং মুনাফা অর্জন হচ্ছে।

গত ২০১৮ সালের ১২ই মে (যুক্তরাষ্ট্র সময় ১১ই মে) ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্পেস এক্স এর সর্বাধুনিক ফ্যালকন-৯ রকেটে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশ জয়ের ইতিহাসে নাম লেখায় বাংলাদেশ।

মূলত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করে দেশের বেসরকারি সব টেলিভিশনের সম্প্রচার পরিচালনা হচ্ছে। এছাড়া ডিটিএইচ ও রেডিও সম্প্রচার, দুর্গম অঞ্চল ও দূরবর্তী দ্বীপাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা দেওয়ার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে।

বিএসসিএল সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে নাম লেখায় বাংলাদেশ। ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব এই স্যাটেলাইট নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণ করে একক মালিকানা অর্জন করে বাংলাদেশ।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, আমাদের পুরো বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কেবল মাত্র একটা স্থাপনা অথবা একটা ইভেন্ট না। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আমাদের জন্যে একটা গৌরবের বিষয়। এটি আমাদের জাতীয় গর্ব। আমাদের সৌভাগ্যের বিষয় যে আমরা যেদিন থেকে স্যাটেলাইট পরিচালনা করা শুরু করেছি সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ কোনো ত্রুটির সম্মুখীন হইনি। আরও গৌরবের বিষয় হলো- এই স্যাটেলাইট পরিচালনা করছে আমাদের ছেলে-মেয়েরা। আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদেরকে দক্ষ করে তুলেছি।

মন্ত্রী বলেন, প্রথম স্যাটেলাইট সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করার ফলে আমাদের আত্মবিশ্বাস এতো বেশি বেড়েছে যে, আমরা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর কাজ অনেক এগিয়ে নিয়েছি। ইতিমধ্যে আমরা ৩১টি দ্বীপে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কানেক্টিভিটি দিয়েছি। আরও কাজ চলমান রয়েছে।

[বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আয় নিয়ে কিছু চিহ্নিত গণমাধ্যমের মিথ্যাচার: সত্য জানুন]

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মুলত একটি ষ্টেশনারি স্যাটেলাইট। এর কাজ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা। ইতিমধ্যে হন্ডুরাস, তুরস্ক, ফিলিপাইন্স, ঘানা, ক্যামেরুন, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশের বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করছে। বাংলাদেশি টিভি চ্যানেলগুলো থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর আয় ১১ কোটি টাকারও বেশি।

একই সাথে অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোকে বিজ্ঞাপনমুক্ত ক্লিনফিড দিতে বাধ্য করা, ব্যাংকিং এবং এটিএম নেটওয়ার্ক, সমুদ্রে বাংলাদেশি নৌযানগুলোকে কমিউনিকেশন চ্যানেলে সম্পৃক্ত করা, দেশের সামরিক বাহিনীর যোগাযোগ এবং মিলিটারি ইনফরমেশন আদানপ্রদানে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব কাজের জন্য পূর্বে সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্যাটেলাইটগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো।

বিশ্বের অন্যান্য অংশের স্যাটেলাইটগুলোর সাথে যোগাযোগ করে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও সার্ভিস প্রদান করার চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এছাড়া নেপাল এবং মিয়ানমারও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছে।

২০২৩ সাল নাগাদ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ থেকে পরিপূর্ণ মাত্রায় লাভ আসতে শুরু করবে। একইসাথে নিজ দেশে স্যাটেলাইট ব্যবহারের পরিধি আরও বাড়ছে ক্রমে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু দেশের গণমাধ্যম এবং টিভিতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর পরিষেবা দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচার করছে বিএসসিএল কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুনঃ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে যুক্ত হলো টিভি চ্যানেল ও ব্যাংক

বিএসসিএল চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ আমাদের ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসার প্রকল্প। এর সঙ্গে আমাদের অনেক গর্ব, স্বপ্ন জড়িত রয়েছে। ১৯৭৫ সালে এ পথ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে এর সূচনা করেন সেসময়। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্যে ছিল স্যাটেলাইট দিয়ে টেলিভিশন স্টেশনগুলোকে সেবা দেবো। এটা এখন শতভাগ করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১

এবার আসা যাক, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ প্রসঙ্গে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর যোগাযোগ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ কে লো আর্থ অবজারভেটরি স্যাটেলাইট হিসেবে নির্মাণ করা হবে। এটি ভুমি থেকে ৫০০-১০০০ কি. মি. ওপরে থাকবে। যা আমাদেরকে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভুমির ম্যাপিং, সমুদ্র এবং সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা ও নজরদারির কাজ করবে।

মূল কথা, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সামরিক এবং যোগাযোগ উভয় ক্ষেত্রেই একই সাথে কাজ করবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। দ্বিতীয় স্যাটেলাইটটি মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সীমান্ত আর দেশের অভ্যন্তরীণ ডাটা সংগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহৃত হবে।

আরও পড়ুনঃ ২০২৩ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণ

সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্যাটেলাইট থেকে এই সেবা ক্রয় করা হতো বলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যেত। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-এর মাধ্যমে এটা বন্ধ হবে। যদিও সিঙ্গাপুরভিত্তিক সার্ভিসের আওতায় বাংলাদেশের নিজস্ব সীমান্ত এলাকা কিংবা সমুদ্রসীমায় নজরদারির কোনো সক্ষমতা আমাদের এখন পর্যন্ত নেই। তাই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২-কে কে ডাটা এবং নিরাপত্তা ও সার্ভেইল্যান্সের কাজসহ বিভিন্ন বিষয়ে সক্ষম করেই ডিজাইন করা হবে।

ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণের জন্য বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড এবং গ্লাভকসমস (রাশান স্টেট স্পেস কর্পোরেশনের সাবসিডিয়ারি)-এর মধ্যে ৪৩৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণ করেছিল ফ্রান্স এবং উৎক্ষেপণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে এতে খরচ অনেকটা বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর ক্ষেত্রে নির্মাণ ও উৎক্ষেপণ দুটোই করবে রাশিয়া। ফলে এই খাতে খরচ অনেক কমে যাবে।

১৫টি ছোট স্যাটেলাইটের ফাংশনালিটির বদলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ মূলত ৬টি বৃহৎ স্যাটেলাইটের ফাংশনালিটি প্রদান করবে। একই সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে বেসামরিক তথ্য পরিষেবা গ্রহণকারী পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে প্রদান করবে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কোনো বিলাসবহুল অহেতুক পরিকল্পনা নয়। নিতান্তই নিজস্ব প্রয়োজন বিবেচনা করেই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

তবে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান গ্লাভকসমস বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ নির্মাণ এবং উৎক্ষেপণের কাজ পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নির্মাণকারী ফ্রান্স এবং উৎক্ষেপণকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- উভয়পক্ষই মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে। এছাড়াও মার্কিন বলয়ে থাকা যুক্তরাজ্য, ভারতসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকে ভালো চোখে দেখছে না।

ফলশ্রুতিতে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম বিবিসি’র বাংলাদেশি অংশ- বিবিসি বাংলা (যেখানে কর্মরত রয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী অগুণিত কর্মী) বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার শুরু করেছে। তথাকথিত ‘বিবিসি’ ব্র্যান্ডনেম এর কারণে মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হয়ে জনমনে অসন্তোষও সৃষ্টি হয়েছে ইতিমধ্যে।

দেশের সাধারণ মানুষ তাই এসব মিথ্যাচারী ও বাংলাদেশবিরোধী গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছেন।

আরও পড়ুনঃ

মার্কিন ব্ল্যাকলিস্টেড সংস্থাকে BS-2 স্যাটেলাইট প্রজেক্ট দিয়ে পাল্টা কূটনৈতিক চাল বাংলাদেশের

আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডে বিএনপি সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও ঘৃণ্য নীলনকশা

শেখ হাসিনার নির্দেশে আমদানি নির্ভরতা কমে দেশে সয়াবিন তেল উৎপাদন ছাড়িয়েছে ৩ লাখ টন