
৭ই মে ২০০৪, এইদিনে বিএনপির সন্ত্রাসীরা বার্স্টফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে গাজীপুরের মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা, শ্রমিক নেতা সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে।
টঙ্গীর বিএনপি নেতা হাসান আলী সরকারের ছোট ভাই নূরুল ইসলাম সরকার টঙ্গী যুবদলের সভাপতি ছিলেন সে সময়। সেদিন যুবলীগের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলন চলাকালে মঞ্চে উপবিষ্ট আহসান উল্লাহ মাস্টারকে প্রকাশ্যে বার্স্টফায়ার করে হত্যা করে নূরুর নেতৃত্বাধীন বিএনপির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা।
ঘটনার সময় মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার এম এ বাতেনসহ ১৫ জন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণে ছিলেন। তৎকালীন আইজিপির মাধ্যমে সিআইডির অতিরিক্ত আইজির নিকট থেকে মোবাইলফোনে নির্দেশ পেয়ে বাতেন স্টাফ কলেজ থেকে ছুটে যান টঙ্গীতে। সিআইডির ঢাকা ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এম এ বাতেন পদাধিকার বলে ছিলেন মামলার সুপারভিশন কর্মকর্তা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মনিটরিং সেলের বৈঠকে আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি তাকে বিস্তারিতভাবে জানাতে হতো।
‘যুবলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের হিসাবে আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়েছে’ তা প্রচার ও প্রমাণ করার জন্য বিএনপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী- দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার অন্যতম কুশীলব, তারেক রহমানের অপকর্মের দোসর লুৎফুজ্জামান বাবর ওরফে লাগেজ বাবর পুলিশকে নির্দেশ দেন।
[আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডে বিএনপি সরকারের সরাসরি সম্পৃক্ততা ও ঘৃণ্য নীলনকশা]
সূত্র জানায়, অনুসন্ধান এবং তদন্তের শুরুতেই বের হতে শুরু করে আসল ঘটনা। ষড়যন্ত্র ও হত্যাকাণ্ডের দায় নিজেদের কাঁধে চাপার উপক্রম হলে বৈঠক ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে বাবর ৩-৪ দিন বাতেনকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিতেন। তার পরিষ্কার নির্দেশ ছিল, যুবদল নেতা নূরুল ইসলাম সরকারকে বাদ দিয়ে মামলার যাবতীয় কার্যক্রম চালাতে হবে। কিন্তু তদন্তে নূরুই যে ঘটনার মূল হোতা তা বেরিয়ে পড়ে।
এদিকে সুপারভিশন কর্মকর্তা বাতেনকে বাগে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখে বাবর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিয়ে নূরুকে রক্ষার কৌশল অবলম্বন করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বারবার ডেকে বাবর পুলিশ কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে বলতেন, আমার কথামত কাজ না করলে ‘খবর আছে’ সবার।
অনুসন্ধান ও তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের নিকট যেসব তথ্য আসে তা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র চালানোর পরই আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়।
পুলিশের সূত্র জানায়, কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। মঞ্চের পিছন দিয়ে কিলারদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রায় অর্ধ কিলোমিটার পর্যন্ত পথের দু’পাশে যুবদলের সশস্ত্র ক্যাডার রাখা হয়েছিল। কিলারদের কেউ ধরার চেষ্টা করলে তাকে সেখানেই হত্যার নির্দেশ ছিল। আর হত্যাকাণ্ডের আগের রাতে নূরুর নেতৃত্বে কিলাররা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে আগ্নেয়াস্ত্র পরীক্ষা করেছিল।
পুলিশ সূত্র জানায়, সেই সময়ে গাজীপুরের পুলিশ সুপার মিসেস ইয়াসমিন গফুর নিরাপত্তার জন্য যুবলীগের সম্মেলনস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন করেননি। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজিকে অন্ধকারে রেখে বাবরের সাথে যোগাযোগ রেখে নিরাপত্তার জন্য নামে মাত্র কয়েকজন পুলিশ পাঠিয়েছিলেন তিনি। কথিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কিলাররা ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুড়ঁতে নির্বিঘ্নে পালিয়ে গিয়েছিল।
বাবর এরপরই ইয়াসমিন গফুরকে গাজীপুর থেকে সরিয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চে নিয়ে আসেন। সরকারের শেষ সময় (অক্টোবর ২০০৬) তাকে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে বরিশাল রেঞ্জে বদলি করা হয়। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ইয়াসমিন গফুর নিজের বদলি বাতিল করিয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চে থেকে যান। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার মতে, বাতেন বদলি না করার অনুরোধ করে উল্টো মিথ্যা ঘুষের মামলায় ফেঁসে যান।
আরও পড়ুনঃ আহসানউল্লাহ মাস্টার বেঁচে থাকবেন মানুষের অন্তরে

জননেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার ছিলেন একজন পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি ছুঁয়ে গেছেন সকল স্তরকে ও সব কিছুকে। বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের মানসপটে তিনি নিত্য ও সদা বিরাজমান।
১৯৫০ সালের ৯ই নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা জেলার (বর্তমানে গাজীপুর জেলা) পুবাইল ইউনিয়নের হায়দরাবাদ গ্রামে আহসান উল্লাহ মাস্টার জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের হায়দরাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর টঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন থেকেই টঙ্গীতে ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।
১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে রাজপথে নামে ছাত্র-ছাত্রীরা। সে সময়ে টঙ্গীতে যে আন্দোলন হয়েছিল তাতে স্কুল পড়ুয়া ছাত্র আহসান উল্লাহ রাজপথে নেমে পড়েন। অংশগ্রহণ করেন মিছিলে। তখন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন।
আহসান উল্লাহ ১৯৬৫ সালে টঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারী কলেজ) একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যখন রাজপথে, তখনও ভাওয়ালের এই সন্তান আহসান উল্লাহ রাজপথের একজন সাহসী সৈনিক। রাজনীতির লড়াকু সৈনিক হিসেবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠতে থাকে।
তিনি পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে রাজনীতি চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করে।
ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহ করার নিমিত্তে টঙ্গী-জয়দেবপুরের জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন আহসান উল্লাহ মাস্টার। তিনি কমিটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে ‘মুজিব তহবিল’-এর জন্য প্রতিটি কুপন ১০ পয়সা করে বিক্রয় করেন। ১৯৬৯ সালে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। আহসান উল্লাহ ১৯৭০ সালে ডিগ্রী পাস করেন।
টঙ্গীর নতুন বাজারে অবস্থিত টঙ্গী উচ্চ বিদ্যালয় আউচপাড়ায় স্থানান্তর হওয়ার পর টঙ্গীর নোয়াগাঁওয়ে এমএ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার জন্য যে ক’জন শিক্ষানুরাগীর অবদান ছিল তাদের মধ্যে শহিদ আহসান উল্লাহ একজন।
স্কুলটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে তিনি ঐ স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক (১৯৭৭-১৯৮৪) ও প্রধান শিক্ষকের (১৯৮৪-২০০৪) দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে আমৃত্যু পালন করেন।
১৯৭১ সালের ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরের ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে আসা পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যারিকেড দিয়ে বাধা দেয়ার জন্য জনতাকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে তার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং ডাক দেন বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আহসান উল্লাহ মাস্টার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগেই তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন এবং নির্যাতিত হন। আহত অবস্থায় আহসান উল্লাহ মাস্টার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়া থেকে গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে ডাঙ্গা, পুবাইল, টঙ্গী, ছয়দানাসহ বিভিন্ন স্থানে গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ বিকেলে দেশ শত্রুমুক্ত হয় ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়। আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে থাকবে।
তিনি শিক্ষকদের নেতা ছিলেন। টঙ্গীর শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের সব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে সবার প্রিয়ভাজন হয়েছেন।
আরও পড়ুনঃ
- ভাসানীসহ যে জাতীয় বেঈমানরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়েছিল
- জার্মান রাষ্ট্রদূতই প্রথম নন, রাজনৈতিক মিথ্যাচার বিএনপির ঐতিহ্য
- ইলিয়াস আলীকে নিয়ে নেত্র নিউজের বানোয়াট গল্পের গোমর ফাঁস