
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও কঠিন বাস্তবতা ছিল এই যে, বঙ্গবন্ধুর ঘরে-বাইরে সর্বত্রই ছিল শত্রুদের সমারোহ। কিছু ঘনিষ্ঠ সহচর থাকলেও তারা ছিলেন কার্যত নির্বিকার। ভীত-সন্ত্রস্ততায় কার্যত তারা জড়পদার্থ হয়ে যান। শিশুপুত্র শেখ রাসেলের চিৎকার যেখানে নেতাদের প্রতিবাদী করতে পারেনি সেখানে জনগণ কী করে ক্ষোভ প্রকাশ করবে? বরং জনগণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সেই রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের ট্র্যাজেডিই নয়, বিশ্বের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। তেমনি খুনিবেষ্টিত হয়ে মন্ত্রীত্বগ্রহণ ও রাজনীতিকদের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাওয়াটাও আরেকটা ট্র্যাজেডি।
ভাসানীর মতো বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দেন- পূর্ব-পাকিস্থানি মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, কাজী জাফর আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও বামপন্থী কমিউনিস্ট দলগুলোও।
বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হয়েও ভাসানীর পদধূলি নিতে ভোলেননি কখনো। বঙ্গবন্ধু মজলুম জননেতার অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন সন্তোষে। রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম ’৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। অথচ ভাসানী ’৭০ নির্বাচনের ন্যায় বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘দেশের জনগণ এখন নির্বাচন চায় না।’
আরো পড়ুনঃ বঙ্গবন্ধু হত্যা: জিয়াউর রহমানের টেনিস-কোর্ট ষড়যন্ত্র
ভাসানী সেসময় জেনারেল জিয়াকে আর্শীবাদ বার্তাও পাঠান। ’৭৬ সালে ভাসানী ইন্তেকাল করেন। ন্যাপ ভাসানীর সাধারণ সম্পাদক স্বাধীনতাবিরোধী মশিউর রহমান যাদুমিয়া জেল থেকে বেরিয়ে জিয়ার মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। ন্যাপ ভাসানীর নেতারা বিএনপিতে শামিল হন।
আতাউর রহমান খান বাকশাল-এ যোগ দিয়েছিলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধু তাকে লন্ডনে পাঠান চিকিৎসার জন্য। ৯ই আগস্ট আতাউর রহমান খানের দুই মেয়েকে গণভবনে ডেকে চিকিৎসার খোঁজ খবরও নেন বঙ্গবন্ধু। সেই আতাউর রহমান খান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানান।
ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনকালে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অনন্য সাধারণ ভুমিকা রেখেছিলেন আমেনা বেগম। তিনিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পক্ষে বিবৃতি দেন। বিবৃতির তালিকায় মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা-দিলীপ বড়ুয়ার নামও অগ্রগণ্য।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে জাসদ ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিলো। জেল থেকে বেরিয়ে জাসদ সভাপতি মেজর (অব.) এমএ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আব্দুর রব রাতারাতি বঙ্গবন্ধুকে স্বৈরাচারী মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বলা শুরু করেন।
জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও হাসানুল হক ইনুর গণবাহিনী ৭ই নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায়। ৩রা নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নায়ক খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়।
আরো পড়ুনঃ মোশতাক ষড়যন্ত্র করতে পারে- এটা আব্বা জানতেন: শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণ
কিন্তু জেনারেল জিয়া জাসদের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ করে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। তাহেরকে দেন ফাঁসি। মেজর জলিল ও আবু ইউসুফ খানকে যাবজ্জীবন ও সিরাজুল আলম খান, আ স ম রব, হাসানুল হক ইনুকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয় জিয়ার সামরিক আদালত।
নেতারা বিবৃতিতে যা বলেছিলেন-
মওলানা ভাসানী তার বিবৃতিতে বলেন, ‘১৫ই আগস্ট ও ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তন অর্থনীতির পুনরুদ্ধার, প্রশাসনিক সচলতার ও আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নের শুভ সূচনা করেছে।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী ৪ বছরকে কু-শাসন, হানাহানি ও দুর্নীতির বছর হিসেবে দাবি করেন তিনি। ’৭৬ সালের ১৩ ও ১৮ই সেপ্টেম্বরে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয় ভাসানীর ওই বিবৃতি। তিনি ’৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মারা যান।
আতাউর রহমান খান বলেন, ‘১৫ই আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থান ছিল অবশ্যম্ভাবী। গণতন্ত্র উত্তরণে যা সহায়ক হয়েছে।’
জেনারেল জিয়া হত্যার পর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দল থেকে বেরিয়ে জেনারেল এরশাদের প্রধানমন্ত্রী হন পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী লীগ সরকারের এই মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে গিয়ে খালেদা জিয়া তাকে দেখে ‘জাতীয় বেঈমান’ বলে বৈঠক স্থান ত্যাগ করেন।
জাতীয় দলের আহবায়ক ও আওয়ামী লীগের এককালীন মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘১৫ই আগস্ট মানব ইতিহাসের জঘন্যতম স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটায়।’
১৫ই আগস্টকে দেশের গণমানুষ স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে অভিনন্দন জানায় বলেও দাবী করেন তিনি।
৩-৭ই নভেম্বরের সময়কে প্রতি অভ্যুত্থান বলে আখ্যায়িত করে বলেন, ‘সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ দেশকে ভারতের চির-গোলামীর নিগড়ে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিলো। কিন্তু ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে পর্যদুস্ত করে ও সেনাবাহিনী সার্থকতার সঙ্গে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।’
আওয়ামী লীগ, মনি সিং এর কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফফরের ন্যাপ এবং জাসদকে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানায় দলটি। ’৭৬ সালের ৩১শে অক্টোবর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক খবরে দেখা যায় আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে এসে তোয়াহা বলেন, ‘১৫ই আগস্ট ও ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তনের পর প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছি।’
’৭৬ সালের ৪ঠা নভেম্বর ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (পিপিপি) সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমেদ বলেন, ‘১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবার আকাঙ্খায় জনগণ অপেক্ষা করছে। এখন তা দেয়া হলে দেশের বুকে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’
কাজী জাফর বলেন, ‘প্রথম শত্রু তারা, যারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট মুজিবের সহযোগী।’
স্বাধীনতাত্তোর ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর পিপিপি গঠন করে জেনারেল জিয়ার জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী হন। পরে এরশাদের প্রধানমন্ত্রীও হন। আবার এরশাদকে ত্যাগ করে পাল্টা জাতীয় পার্টিও গঠন করেন।
এরশাদের আরেক মন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন ’৭৬ সালের ২৮শে নভেম্বর বলেন, ‘১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ১৫ই আগস্ট ও ৭ই নভেম্বরের ঘটনাবলী বাংলাদেশের ওপর ভারত-রাশিয়ার শোষণ আধিপত্য শিথিল হয়।’