
বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশ হওয়ার এক দশক হলো। এ সময়ের মধ্যে নানা গুজব, নানা মুখরোচক গালগল্প ছড়িয়েছে দেশজুড়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবুও তার মেলেনি হদিস। বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান রহস্য এবং বিভিন্ন ফ্যাক্টস ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করা যাক-
প্রারম্ভিক কথা:
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, সবসময় ‘গুম’ শব্দের অর্থ কাউকে হত্যা করে লাশ ভোজবাজির মত বাতাসে মিলিয়ে দেওয়া নয়। রাজনৈতিক কারণে কেউ স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে যায়, বড় অপরাধীরা ভিন্ন নাম-পরিচয়ে (হারিছ চৌধুরীর মত) অন্য কোনো জায়গায় বসবাস শুরু করতে পারেন, প্রতিপক্ষকে বিপাকে ফেলতে বা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নিজ দল বা সংগঠনের লোকজনের হাতেও কেউ ‘গায়েব’ হয়ে যেতে পারেন। গুম শব্দের অর্থটা বিস্তৃত, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে।
যেভাবে লাপাত্তা হন ইলিয়াস:
২০১২ সালের ১৭ই এপ্রিল মধ্যরাতে রাজধানীর ঢাকায় ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়িচালক আনসার আলীকে শেষবারের মতো দেখা গেছে। এরপর ইলিয়াস আলীকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। পরিবার এবং তার দলের দাবি, সাদা পোশাকে থাকা একদল ‘লোক’ ইলিয়াস আলী ও আনসার আলীর গাড়ি থামিয়ে তাকে তুলে নিয়ে গেছে। যারা তুলে নিয়ে গেছে, তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বলে দাবি করেছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। যদিও সরকারী সংস্থাগুলো একে বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। এমনকি ইলিয়াসের পরিবার যখন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছে, তখন প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন।
ইলিয়াসনামা কিংবা ইলিয়াস আলীর খুন খারাবির ইতিহাস:
অনেকেই এই নথিবদ্ধ তথ্য-উপাত্তের অবতারণাকে ইলিয়াসের চরিত্রহননের উপায় বলে ধরে নিতে পারেন। তাই শুরুতেই বলে রাখা প্রয়োজন, এই প্রসঙ্গ এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ ইলিয়াস আলীর অতীত ইতিহাস জানলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে, তার নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, যা নিয়ে আলোকপাত করা জরুরি হলেও করা হচ্ছে না।
নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থার সফেস্টিকেটেড নথিপত্র ঘেঁটে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সেই তথ্য মোতাবেক জানা যায়, ‘৮০ ও ‘৯০ এর দশকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন ইলিয়াস আলী। তিনি ও তার এককালীন প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতা কামরুজ্জামান রতন কুখ্যাত ছিলেন যথাক্রমে ১৮ খুন ও ২২ খুনের মামলার জন্য।
একজন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান ইলিয়াস কোনো দৃশ্যমান পেশা ছাড়াই শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক হন মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে। এরশাদের নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের সশস্ত্র ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়ে অস্ত্রবাজির রাজনীতি শুরু ইলিয়াসের। নতুন বাংলা ছাত্রসমাজের পর হাওয়া বুঝে দলবদল করে ছাত্রদলের অস্ত্রবাজ কর্মী হয়ে ওঠেন তিনি।
আরো পড়ুনঃ ইলিয়াস আলীকে নিয়ে নেত্র নিউজের তথ্য বানোয়াটঃ ইলিয়াস পত্নী
দুর্ধর্ষ নিরু আর বাবলু তখন ক্যাম্পাসের রাজা। পাগলা শহীদের শিষ্য ছিলেন গোলাম ফারুক অভি। শহীদ খুন হন, আর বাবলু তার নিজ কক্ষে রহস্যজনকভাবে বোমা দুর্ঘটনায় নিহত হন। এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অভি-নিরুদের রাজত্ব ছিল। আর আজকের ইলিয়াস আলী সে সময় ছ্যাঁচড়া মাস্তান হিসেবে এদিক-সেদিক করে খেতেন। মহসীন হলে মস্তানির জন্য ইলিয়াস আলীকে মধুর ক্যান্টিনে সবার সামনে কান ধরে ওঠ-বস করান অভি-সজলরা। সে সময় ছাত্রদলের সিনিয়র ক্যাডারদের ফুট-ফরমায়েশ খেটে দিন কাটত ইলিয়াসের।
৯০-এ ডা. মিলন হত্যার কারণে অভি-নিরুদের রাজত্বের অবসান হয়। এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে ছ্যাঁচড়া ক্যাডার ইলিয়াস আলী ফ্রন্টলাইনে এসে নব্য অভি-নিরু হওয়ার চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায়ই নিজ দলে গ্রুপিংয়ের রাজনীতি ঢুকিয়েছিলেন ইলিয়াস আলী। মাফিয়া স্টাইলে গড়ে তোলেন নিজস্ব হিটম্যান গ্যাং। ছাত্রদলের ক্যাডার পরিচিতি দিয়েই উত্থান তার। একের পর এক বিভিন্ন ঘটনার নায়ক হয়ে জন্ম দেন অভ্যন্তরীণ সংঘাত। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যায় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড।
ক্রমান্বয়ে ইলিয়াস আলী পরিণত হন ত্রাস সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসনির্ভর ছাত্রনেতায়। বহু খুনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সে কারণে একাধিকবার গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। জেলে কাটে সময়।
ইলিয়াস পরিক্রমা- (এক নজরে)
→ ১৯৮৭ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী কার্মকান্ডের কারণে ইলিয়াসকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়।
→ ১৯৮৮ সালের ১১ই ডিসেম্বর ছাত্রদল নেতা বজলুর রহমান ওরফে পাগলা শহীদকে হত্যা করেন ইলিয়াস।
→ ১৯৮৯ সালের ২৯শে নভেম্বর ইলিয়াসের নেতৃত্বে ডাকসু কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।
→ ১৯৯০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার নির্দেশে জহুরুল হক হলের ভিপি ছাত্রলীগ নেতা শহীদুর ইসলাম চুন্নুকে মিছিলে গুলি করে হত্যা করেন ইলিয়াস।
→ ১৯৯২ সালের ৩রা অগাস্ট ছাত্রদলের কামরুজ্জামান রতন গ্রুপের সঙ্গে ইলিয়াস গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে ইলিয়াস গ্যাংয়ের গুলিতে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি নিহত হন।
→ ১৯৯২ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর মামুন ও মাহমুদ নামে দুই ছাত্রদল নেতাকে হত্যা করে লাশ পানির ট্যাংকের ভিতর লুকিয়ে রাখেন ইলিয়াস ও তার কর্মীরা।
→ ১৯৯১ সালে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে ছাত্রদল নেতা মির্জা গলিব ও ছাত্রলীগ নেতা লিটন হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ইলিয়াসকে।
→ ১৯৯২ সালে ১৬ই জুন ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন করা হলে রুহুল কবির রিজভী সভাপতি ও ইলিয়াস সাধারণ সম্পাদক হন। ৩ মাসের মাথায় ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা স্বত্বেও ‘৯৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর মামুন ও মাহমুদ হত্যা মামলায় আবার গ্রেপ্তার হন ইলিয়াস। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। ২ বছর কারাবাসের পর মুক্তি পান তিনি।
→ ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মত দলীয় মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ইলিয়াস।
সিলেটের অনেক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ইলিয়াস আলী ও তার ক্যাডারদের হামলার মুখে পড়েন। এম সাইফুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো বরেণ্য ব্যক্তিরাও ইলিয়াসের সন্ত্রাসের শিকার হন বারবার। সড়ক দুর্ঘটনায় সাইফুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনাকেও অনেকে ইলিয়াসের পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলে মনে করেন।
শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও উচ্ছৃংখল আচণের দায়ে পুলিশের নজরবন্দি হতে হয় ইলিয়াস আলীকে। ২০০০ সালে লন্ডনের মিল্টন কিন্স শহরে জয়পুর রেস্টুরেন্টে ওয়েটারকে হত্যার হুমকি দেন তিনি। কর্তৃপক্ষ পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করে দিয়ে যায় তাকে।
আরো পড়ুনঃ হারিছ চৌধুরীর পর এবার ইলিয়াস আলীকে নিয়ে ধূম্রজাল
→ ২০০১ সালে এমপি হওয়ার পর বিশ্বনাথ বালাগঞ্জে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করেন ইলিয়াস। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মাঠে নামেন ইলিয়াস বাহিনীর ক্যাডাররা।
→ সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যার উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল মাজার গেটে গ্রেনেড হামলার অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
→ ২০১২ সালের ৩রা এপ্রিল সিলেটে ইলিয়াস আলীর প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছাত্রদল নেতা দিনার ও জুনায়েদকে গুম করার অভিযোগ আছে ইলিয়াসের বিরুদ্ধে।
→ ২০১১ এর ১১ই ডিসেম্বর “ইলিয়াস দেশে না বিদেশে’ শিরোনামে সংবাদ ছাপা হয়। প্রথমে বিদেশে যাওয়ার কথা অস্বীকার করে পরে তিনি নিজেই স্বীকার করেন, তিনি ব্যাংকক গিয়েছিলেন গোপনে।
ইলিয়াস আলী আজ পর্যন্ত কত মানুষকে হত্যা করেছেন, কত সন্ত্রাসী নিজে তৈরী করেছেন, কত মায়ের বুক খালি করিয়েছেন, কত দুর্নীতি-ডাকাতি করেছেন, কত সন্ত্রাসী বাহিনী পরিচালনা করেছেন, তার হিসাব কেউ রাখেনা। শতকোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার বনানীতে ‘সিলেট হাউজ’ নামে বিশাল বাড়িও করেছেন তিনি অবৈধ অর্থে। তার নামে রয়েছে প্রচুর মামলা। সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, হুমকি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আছে। ২০০১-এর নির্বাচনে দল ক্ষমতায় আসার পর ইলিয়াস আলী ও তার লোকেরা বহু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে হামলা চালান। আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের খড়গ চালান।
এতসব অত্যাচার-নিপীড়নের অসংখ্য বিতর্কিত ঘটনার নায়ক ইলিয়াস আলী সবকিছু পাশ কাটিয়ে ফিল্মি স্টাইলে দেশব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠেন একমাত্র বিএনপির নীতিনির্ধারকদের প্রত্যক্ষ মদদে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের চেয়ে নিজ দলের নেতা-কর্মীদের ওপরেই ইলিয়াস বেশি চালিয়েছেন নির্যাতন এবং করেছেন হত্যা।
এমন একজন খুনি ও অগুণিত মামলার আসামি, যিনি জীবনভর কোন্দল-গ্রুপিং, খুন-খারাবিতে পুরো সময় পার করেছেন, দলের নামে নিজের স্বার্থ হাসিল করেছেন, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত, তাকেই করা হয়েছিল দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। এমন নেতার নিরুদ্দেশ কি স্বেচ্ছায় নাকি নির্যাতিত দলীয় নেতা-কর্মীদের ইশারায়- সেটা নিয়ে নিশ্চয় জোরালো তদন্ত হওয়া উচিৎ।
ইলিয়াসের নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে মির্জা আব্বাসের বক্তব্য এবং লন্ডনি ধমকিতে পল্টি:
ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশের ৯ বছর পূর্তিতে বিএনপির এক ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে হুট করে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস করে দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি জানান, ইলিয়াস আলী নি’রুদ্দেশের নেপথ্যে সরকার নয়, বিএনপির লোকই রয়েছে। ১৭ই এপ্রিল, ২০২১ সালের বিকেলে ঢাকাস্থ সিলেট বিভাগ জাতীয়তাবাদী সংহতি সম্মেলনীর উদ্যোগে আয়োজিত সেই সভায় মির্জা আব্বাস বলেন, আমি জানি, বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী লীগ সরকার ইলিয়াসকে গুম করেনি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আব্বাস বলেন, নেপথ্যে আমাদের দলে যারা রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা দরকার, তাদের সবাই জানেন। আগের রাতে দলীয় অফিসে এক ব্যক্তির সঙ্গে ইলিয়াসের বাগবিতণ্ডা হয়। তখন ইলিয়াস খুব গালিগা’লাজ করেন তাকে। সেই যে পেছন থেকে দংশন করা সাপগুলো, দলে এখনো রয়ে গেছে। যদি এদের দল থেকে বিতাড়িত না করেন, তাহলে কোনো পরিস্থিতিতেই দল সামনে এগোতে পারবে না।
এই ভার্চুয়াল বৈঠকের সেই ভিডিওটি কেউ সুকৌশলে ফাঁস করে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। মুহূর্তে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে মির্জা আব্বাসের সেই কথাগুলো। সরকারি দলসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা নড়েচড়ে ওঠে। বিএনপির সমালোচনায় সরব হয়ে ওঠে চারপাশ। অবস্থা বেগতিক দেখে বিএনপির পলাতক নেতা তারেক রহমান লাগান ধমক। ধমক খেয়ে রাতারাতি ভোল বদলান মির্জা আব্বাস। পরদিন ১৮ই এপ্রিল রাজধানীর শাজাহানপুরে নিজের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস পল্টি দিয়ে বলেন, পত্র-পত্রিকায় আমার বক্তব্য বিকৃত করে ছাপা হয়েছে। টেলিভিশনে ও প্রিন্ট-মিডিয়ায় বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে। আমি এরকম কিছু বলিনি। আমি যা বলেছি, দলের ভালোর জন্য বলেছি। আমি বুঝি না, সরকার ও সাংবাদিকরা কেন আমাকে টার্গেট করেছে।
ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে বক্তব্য কীভাবে গণমাধ্যমে প্রচার হলো, একে ষড়যন্ত্র বলেও দাবি করেন তিনি। কারো চাপে তিনি বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন কি না, এমন প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান তিনি। যদিও তার বক্তব্যের অখণ্ড ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও দেখা যায়।
ইলিয়াসের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে কি তারেকের হাত:
মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের পর খোদ বিএনপির ভেতরেই তোলপাড় শুরু হয়। দলত্যাগকারী অনেক বর্ষীয়ান নেতার মতে ইলিয়াসকে নিজের ট্রাম্পকার্ড বানিয়েছেন তারেক নিজেই। তাদের মতে, তারেক হয়ত ভেবেছিলেন, ইলিয়াসের মত বিতর্কিত নেতাকে গুম করে সরকারকে দোষারোপ করলে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে। সরকারের পতন ত্বরাণ্বিত হবে। যদিও ১০ বছরেও তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
তবে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন তারেক, সেটাও বলা যায় না। কারণ ইলিয়াসকে ইস্যু করে অর্থলোভী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে লবিং করিয়ে এলিট ফোর্স র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার খড়গ ফেলা গেছে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কিছুটা কলঙ্কিত করা গেছে- এটাই বিএনপির একমাত্র সাফল্য।
ইলিয়াসের নিরুদ্দেশে লাভ কাদের:
সিলেট বিএনপির রাজনীতি দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষে ছিলেন বিএনপির সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, অন্যদিকে শক্ত অবস্থানে ছিল ইলিয়াস আলীর পক্ষ। তবে চার দলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা শেষ হলে সিলেট বিএনপিতে সাইফুর রহমানের নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। এককভাবে সিলেট বিএনপিকে কব্জায় নেন ইলিয়াস আলী। তার দাপটে মুখ খুলতে পারতেন না সাইফুর অনুসারীরা। একসময়ের ছাত্রদলের কুখ্যাত সন্ত্রাসী ইলিয়াস সিলেটের বিএনপি একাই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করলে প্রতিদ্বন্দ্বী সাইফুর রহমানের অনুসারীরা তার ওপর নাখোশ হন। ইলিয়াস থাকলে সিলেটে বিএনপিতে সাইফুর অনুসারীদের কোনো প্রভাব থাকবে না, এই আশঙ্কা থেকে তাকে সরানো জরুরি- বিষয়টি কানে যায় তারেক রহমানের।
অভিযোগ রয়েছে, তারেকের গ্রিন সিগনালে সাইফুর রহমানের অনুসারী এম নুরুল হক, শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী ও বদরুজ্জামান সেলিমরা তৎপর হন। যার পুরস্কারও পান তারা। ২০১৪ সালে সিলেট নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষিত হলে তাতে শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও বদরুজ্জামান সেলিমকে সদস্যসচিব করা হয়। এই কমিটি থেকে বাদ পড়েন ইলিয়াসের অনুসারীরা।
ইলিয়াস আলীর অনুসারী সিলেট বিএনপি নেতা ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ইলিয়াস ভাইয়ের গুমের পেছনে দায়ী সাইফুর রহমানের অনুসারী এম নুরুল হক, শাহরিয়ার হোসেন চৌধুরী ও বদরুজ্জামান সেলিমরা। আমরা ইলিয়াস আলীর গুমের পেছনে দায়ীদের সবার সাজা চাই।
তারেক সে সময় এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বলেছিলেন, ক্ষমতায় আসতে হলে কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়।
ইলিয়াসকে বলি দিয়ে পরবর্তীতে তার নিরুদ্দেশের পেছনে সরকারকে দোষারোপ করা হয়। যা বিএনপির রাজনীতির একমাত্রা ট্রাম্পকার্ড হিসেবে গত ১০ বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিজেদের নাক কেটে হলেও আওয়ামী লীগের যাত্রাভঙ্গের চেষ্টার এমন দৃষ্টান্ত বিএনপির জন্য নতুন নয়। এর আগেও বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনের গুমের দাবি করেছিল বিএনপি, সরকারকে বিপাকে ফেলতে। যদিও সেই সালাহউদ্দিনের সন্ধান মিলেছে ভারতে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সেখানে ভুয়া নাম-পরিচয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। যদিও ভারতীয় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিনের দাবি, তিনি কীভাবে ভারতে এসেছেন, তা জানেন না! এ নিয়ে ব্যাপক হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বক্তব্যে জল আরও ঘোলাটে:
বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রায়ই দাবি করেন, দলের নিরুদ্দেশ হওয়া নেতারা ফিরে আসবেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের যদি এত বছরেও সন্ধান না মেলে, গুম হওয়ার পেছনে বিএনপির লোকজনের হাত যদি না থাকে, তবে তারা ফিরে আসবেন- এমন দাবির পেছনে রহস্য কী? বিএনপি কি তবে নিরুদ্দেশ ব্যক্তিদের সন্ধান জানে?
গত ১৭ই এপ্রিল ২০২১ তারিখে ঢাকায় সিলেট বিভাগ জাতীয়তাবাদী সংহতি সম্মিলনী সভায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা জানি, ইলিয়াস আলী আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের অন্য ছেলেরা যারা হারিয়ে গেছে, গুম হয়েছে, তারাও ফিরে আসবে।
সেদিন বিকেলেই মির্জা আব্বাস ভার্চুয়াল সভায় মির্জা ফখরুলের উপস্থিতিতেই দলের লোকজনকে ইলিয়াস আলীর গুমের পেছনে দায়ী করে সেই বক্তব্য দিয়েছিলন।
এখানেই শেষ নয়। এরপর গত ৮ই জুন ২০২১ তারিখে জিয়াউর রহমানের ৪০তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষে নয়াবাজারে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসব। যখনই আমরা আসব, আমাদের গুম হওয়া ভাইদের ফিরিয়ে আনব।
নজরুল ইসলাম খানের এই বক্তব্য নিয়ে সেসময় ব্যাপক আলোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিএনপি কি তবে জানে, নিরুদ্দেশ ব্যক্তিরা সবাই কোথায় ঘাপটি মেরে রয়েছে! ক্ষমতায় গেলে তাদের নিরুদ্দেশ থাকার প্রয়োজনীয়তা ফুরাবে, তখন তাদেরকে আবার জনসম্মুখে ফিরিয়ে আনা হবে! বিএনপি নেতাদের বক্তব্য তো মির্জা আব্বাসের সেই বক্তব্যের সত্যতার ইঙ্গিত দেয়।
বিএনপি নেতাদের গুমের পেছনে বিএনপি- একটি সাম্প্রতিক ঘটনা:
গত ২রা মে, ২০২১ তারিখের ঘটনা। কুমিল্লার লাকসামে পুলিশ পরিচয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পৌরসভা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক মনির আহমেদকে তুলে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করে পুলিশের সহায়তায় রক্ষা পেয়েছেন।
মনির আহমেদ জানান, ওই রাতে লাকসাম পৌর ছাত্রদল সভাপতি নূরে আলম মিন্টুর নেতৃত্বে তার বসত ঘরের দরজা-জানালায় ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করতে থাকে স্থানীয় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তারা নিজেদের পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে বলে। মনির দরজা না খুলে জানালা খুলে তাদেরকে জানালার সামনে আসতে বলে, কিন্তু তারা জানালার পাশে না এসে মনিরকে দরজা খুলতে হুমকি দিতে থাকে। এ সময় ভয় পেয়ে মনির জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে পুলিশের সহায়তা কামনা করেন। দ্রুততম সময়ে লাকসাম থানা পুলিশ মনিরের বাড়িতে উপস্থিত হন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে লাকসাম পৌর ছাত্রদল সভাপতি নূরে আলম মিন্টু ও তার অনুসারীরা বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়।
পরদিন মনির গণমাধ্যমকে বলেন, এর আগেও আমার সাথে ছাত্রদলের কমিটি গঠন নিয়ে অনেকবার বিবাদে জড়িয়েছে পৌর ছাত্রদল সভাপতি নূরে আলম মিন্টু। আমার সাথে সে অনেকবার অশোভন আচরণ করেছে। বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে যেতে একাধিকবার আমাকে নানাভাবে হুমকি দিয়েছে সে। গত জাতীয় নির্বাচনের একদিন আগে আমার ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে সায়েদুল ও তার অনুসারীরা। আমার ধারণা মিন্টুই আমাকে হত্যা কিংবা গুমের উদ্দেশ্যে এসেছিলো। তাৎক্ষণিক আমি ৯৯৯ নম্বরে কল দিলে লাকসাম থানা পুলিশ এসে আমাকে রক্ষা করে।
পাঠক, কী বুঝলেন? স্বার্থ হাসিলে পুলিশের নাম-ছদ্মবেশ ধারণ করে কে বা কারা?
গুজব পোর্টাল নেত্র নিউজের নয়া গুজব এবং বড় বড় ফাঁক-ফোকর:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁকা কলসি দিয়ে চমক সৃষ্টি করতে হলে (পড়ুন: ভাইরাল হতে চাইলে) কিছু টেকনিক আছে। যেমন সারবস্তুহীন কোনো ফেসবুক পোস্ট, ইউটিউব ভিডিও বা বিভিন্ন ভুঁইফোড় পোর্টালের সংবাদকে যদি হিট করতে হলে কিছু বিশেষ শব্দ বা উপকরণ ব্যবহৃত হয়। এতে রয়েছে- গোপন নথিপত্র, চাঞ্চল্যকর তথ্য, রঙিন স্লাইড, সাসপেন্স সৃষ্টিকারী মিউজিক ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড হিসেবে ব্যবহার… ইত্যাদি।
‘অমুক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা’, ‘তমুক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্র’, ‘অমুক গোপন নথি আমাদের হাতে এসেছে’- এমন মার্কামারা তথ্যসূত্রের দাবিতে বিদেশে বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো অনেক সহজ। কারণ জবাবদিহিতা লাগে না এসব গালগল্প তৈরিতে। মূলত বিভিন্ন হিন্দি টিভি সিরিয়ালে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে নেতা ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশ বিষয়ক একটি গুজবচিত্র। একটু বিশ্লেষণ করা যাক-
ডিজিএফআই-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘একজন সামরিক কর্মকর্তার’ বরাতে একটি নথির দাবি করেছে নেত্র নিউজ। যে নথির সত্যতা এবং ইলিয়াস আলীর গুম রহস্য নিয়ে কাজ করেছেন নেত্র নিউজের সংবাদকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান! পাঠক, হাসতে হাসতে উল্টে পড়ছেন না তো জুলকারনাইন সায়ের খানের নাম শুনে? মনে পড়ে কিছু? এই সেই জুলকারনাইন সায়ের, যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সেনাবাহিনী নিয়ে নির্মিত গুজবচিত্রের অন্যতম অভিনেতা। এই সেই জুলকারনাইন সায়ের, যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তানভীর সাদাত, সায়ের জুলকারনাইন, জুলকারনাইন সায়ের, সামিউল ইসলাম, জুলকারনাইন সামিসহ বিভিন্ন নামে পরিচয়পত্র তৈরি করে প্রতারণার অসংখ্য অভিযোগ ও তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।
গহনা চুরি, র্যাব পরিচয় দিয়ে ভুয়া চেকের মাধ্যমে প্রতারণামূলকভাবে ১০টি ল্যাপটপ কেনা, পিতার সামরিক পোশাক পরে ভুয়া পরিচয় দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে প্রতারণার জন্য ইতিপূর্বে তিনি র্যাব ও পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। এসব ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ দেশের প্রধান প্রধান প্রায় সকল গণমাধ্যমে তার ছবিও প্রকাশিত হয়।
তার এসব কর্মকাণ্ডে সৎ জীবন-যাপন করা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা পিতা অত্যন্ত ব্যাথিত হন, এক পর্যায়ে সেই বেদনা সইতে না পেরে স্ট্রোক করেন। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠে সামিকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। তবুও নিয়মিত সামির অপকর্মের খবর তার কানে আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত অধিক শোকে তিনি মারা যান। এইচএসসি ফেল সেই সামি জন্মদাতা পিতার নাম পরিবর্তন করে ভুয়া কাগজপত্র নিয়ে শ্বশুরের টাকায় শ্রমিক হিসেবে হাঙ্গেরিতে পাড়ি দেন।
এই জুলকারনাইন সামি এখন সাংবাদিক সেজে তথাকথিত গোপন নথির সত্যতার সনদ দিয়েছেন! হাততালি দেওয়া যেতে পারে।
সেই ‘গোপন নথিতে’ দাবি করা হয়েছে, ইলিয়াস আলী যেখান থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন, সেখানে ৮টি সিটিসেল নাম্বার সক্রিয় থাকার তথ্য মিলেছে। যে নাম্বারগুলো ইলিয়াস আলীর নিরুদ্দেশের আগে ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে উত্তরার দেশ টেলিকম নামে একটি দোকান থেকে কেনা হয়। নম্বরগুলো ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার আগে চালু হয়, গুম কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়!
মাহেঞ্জোদারো যুগের কথা মনে পড়ছে? রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো কি এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে, একটা গোপন মিশন সম্পন্ন করতে হলে তাদেরকে মোবাইল ফোনের সংযোগ কিনতে হবে, আবার সেটা কিনতে হলে ভুয়া কাগজপত্রও যোগাড় করতে হবে, শুধু তা-ই নয়, নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলো ফেলে দিতে হবে! রাষ্ট্রীয় সংস্থার রিসোর্সের অভাব? তাদের লেভেলের সাথে যায় এসব? এসব তো পাড়াতো ছিঁচকে মস্তানদের কাজের ধারা।
যেখানে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে দাবি করা হচ্ছে, যেখানে কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল সম্পৃক্ত দাবি করা হচ্ছে, সেখানে শর্ট রেঞ্জ কমিউনিকেশন সিস্টেম, নির্দিষ্ট চ্যানেলের ওয়াকিটকি, মনিটরিং সিস্টেম থেকে বাদ দেয়া মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করা যেত আরও সহজে। এমনকি রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেসময় সিম বেচা হতো দেদারসে, সেখান থেকে নেয়া সিম ব্যবহার করা যেত, যার রেজিষ্ট্রেশনও বাইপাস করা যেত সহজে। মোবাইলফোনে কমিউনিকেশন টুলস ব্যবহার করা যেত। চাইলে এমনকি ভিওআইপিতে ব্যবহৃত সিমও ব্যবহার করা যেত- এমন বহুবিধ ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
কিন্তু এসব সহজ পথে না গিয়ে সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরকে কি না বিএনপি নেতার মালিকানাধীন মোবাইল কোম্পানির সংযোগ ব্যবহার করতে হলো? সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর এমন দৈন্যদশা? নেত্র নিউজের এসব যুক্তি হাস্যকর মনে হয় না? তাছাড়া, যদি সেই সিটিসেল সংযোগ ব্যবহারকারীরাই সম্পৃক্ত হন ইলিয়াসের গুমের পেছনে, তাতে তারা সরকারি সংস্থার লোক- এটা প্রমাণিত হবে? বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী এম মোরশেদ খানের মালিকানাধীন সিটিসেলের সংযোগ ব্যবহার করতে পারে না ইলিয়াসকে গুম করার মিশনে জড়িতরা নিজ দলের লোকেরা? খুব কি কষ্ট-কল্পনা মনে হয়?
নেত্র নিউজের দাবি, সরকারি সংস্থার তিনটি দল এতে জড়িত ছিল, যার একটি ডিজিএফআই সদর দপ্তরে অবস্থিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার বা এনএমসি থেকে অপহরণকারী টিমকে সার্বক্ষণিক মোবাইল মনিটরিং সুবিধা প্রদান করছিলো। যদি এটা সত্যি হয়, তবে যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করলেই তাদের আগের দাবিটি হাস্যকর মনে হবে। এনএমসি-তে যদি একটা দল উপস্থিত থাকে, তবে ফিল্ড অপারেটরদেরকে কষ্ট করে ভুয়া আইডি দিয়ে সিটিসেলের সংযোগ নিতে হচ্ছে কেন? তারা তো নিজস্ব চ্যানেলের ওয়াকিটকি কিংবা যে কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেই পারত। মিশন শেষে ডাটাবেজ থেকে ডাটা মুছে দিলেই হতো।
এছাড়া, ইলিয়াস আলীর মত একজনকে তুলে নিতে হলে ১০/১২ জনের ফিল্ড অপারেটরের টিম এবং আরও কয়েকটা ক্ষেত্রে সক্রিয় দুটো টিম ডিপ্লয় করতে হলো কেন- হলিউডি বা তামিল সিনেমার নিয়মিত দর্শকরা নেত্র নিউজের বাটপার জুলকারনাইন সামিকে নিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয় হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। আরেকটু যোগ করা যাক, বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই নেত্র নিউজেরই সন্নিবেশিত ভিডিওতে নিজ বক্তব্যে বলেছেন, ইলিয়াস আলীকে যারা তুলে নিয়ে গেছে, তাদের হাতে ছিল ওয়াকিটকি। আর নেত্র নিউজ সিটিসেলের গপ্পো ফেঁদেছে একই আর্টিকেলে- ব্যাপক মজার বিষয় না?
নেত্র নিউজ আরও দাবি করছে, একজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা নাকি ইলিয়াসকে সিলেট থেকে বিমানে অনুসরণ করে ঢাকায় এসেছেন! গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রটোকল অনুসারে, কাউকে অনুসরণ করার মত গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয় একেবারে নিম্ন পদমর্যাদার উচ্চ প্রশিক্ষিত কাউকে, যে ভিড়ের মাঝে মিশে যেতে সক্ষম। বড় কোনো মিশন থাকলে এসব কাজে একাধিক ব্যক্তি নিয়োজিত হন। ইলিয়াস রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি দেশ ছেড়ে অন্য দেশেও যাচ্ছিলেন না যে, তাকে অনুসরণ করত বিমানেই চড়ে বসতে হবে।
ডমেস্টিক ফ্লাইটে একজন বেসামরিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিকে অনুসরণ করতে বিমানে ওঠার প্রয়োজন পড়ে না, যদি না মাঝে কোনো ট্রানজিট পয়েন্ট থাকে। সিলেট বিমানবন্দর থেকে ঢাকায় ইনফরমেশন দিয়ে দিলেই ট্রেস করা সহজ। এখানে একজন ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে একজন রাজনৈতিক নেতাকে অনুসরণের কাজে লাগানোর মত হাস্যকর দাবি গাঁজাখোর ছাড়া কেউ করতে পারে না।
সেই ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) নেত্র নিউজের এই গুজব প্রচার সম্পর্কে বলেছেন, “আপনাদের (নেত্র নিউজ) কেউ একজন ভুয়া ও বানোয়াট তথ্য দিয়েছে। [র্যাবের] গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা এই অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বরং তাদের দেওয়া বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ইলিয়াস আলীর পরিবারের সদস্য ও স্ত্রীকে নিয়ে বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়েছে। আমি দুনিয়ার কোথাও নিজ চোখে ইলিয়াস আলীকে দেখিনি। অতএব, বিমানে তার ওপর নজরদারি করার প্রশ্নই আসে না।”
এছাড়া. ডিজিএফআইয়ের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তা নেত্র নিউজের গুজব প্রচার সম্পর্কে বলেছেন, “এটি একটি ভুয়া ডকুমেন্ট। এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করার জন্য কেউ একজন আপনাদের (নেত্র নিউজ) এটা দিয়ে থাকতে পারে।”
বাংলাদেশের গুমের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের গুম বিষয়ে ঘুমে তথাকথিত মানবাধিকার সংস্থা:
গত এক দশকে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা- হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে ৮৬ জনের নাম-ধাম উল্লেখ করেছে। দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি এই প্রতিবেদন নিয়ে বেশ উদ্বেগ জানান। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরে লাখ লাখ গুমের বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের অধীনে পচিালিত ন্যাশনাল মিসিং অ্যান্ড আনআইডেন্টিফায়েড পারসনস ডাটাবেজ (এনএএম)-এর তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৬ লক্ষ মানুষ ২০২১ সালেই নিখোঁজ। ৪ হাজার ৪০০ বেওয়ারিশ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে একই বছর, যাদের কোনো পরিচয় এখনও জানা যায়নি। গত এক দশকে ১৭ হাজার নিখোঁজ ব্যক্তি এবং ১৩ হাজার বেওয়ারিশ লাশ বা মরদেহ সম্পর্কে আজ অব্দি কোনো সঠিক তথ্য মেলেনি। অথচ সেই যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সবক দেয়, সত্যি সেল্যুকাস!
নেত্র নিউজের প্রতিক্রিয়ায় ইলিয়াসের পরিবারের বক্তব্য:
নেত্র নিউজের ১৪ মিনিটের ভিডিও ও আর্টিকেলে যেসব তথ্য দিয়েছে, তার ৮০ ভাগই ভুল ও বানোয়াট বলে দাবি করলেন ইলিয়াসপত্নী তসলিমা রশিদ লুনা। গুম ব্যক্তিদের নামটুকুই শুধু সত্য এই প্রতিবেদনে, বাকি সমস্ত তথ্য সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলে দাবি লুনার। বানোয়াট ওই ভিডিও ও সংবাদ প্রকাশের গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে এ কথা জানান তিনি।
ইলিয়াসপত্নী বলেন, আমি নেত্র নিউজের ভিডিওটা দেখেছি। সেখানে আমার স্বামীর যে মোবাইল নম্বর তারা প্রচার করেছে সেটা আমার স্বামীর নয়। এছাড়া গাড়ির ড্রাইভার নিয়েও তারা ভুল তথ্য দিয়েছে। আমি ঘটনার দিন রাতে আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছি। অথচ ওরা (নেত্র নিউজ) বলছে রাত ১১টা থেকে ইলিয়াস আলীর মুঠোফোন বন্ধ, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
লুনা আরও বলেন, এছাড়া নেত্র নিউজের দাবি- র্যাব আমার স্বামীকে গুম করেছে। এটাও মিথ্যা। কারণ আমার স্বামী গুম হওয়ার পরে র্যাব তাকে খুঁজতে আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। নেত্র নিউজ এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ করবে আমার ধারণা ছিলো না। এমন কিছু আঁচ করতে পারলে আমি তাদেরকে বক্তব্য দিতাম না। ওদের এমন ভুল সংবাদ উল্টো জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে।
ইলিয়াস কি তবে হারিছের মত ভোল বদলে লন্ডনে?
মাসখানেক আগে লন্ডন বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা তার ফেসবুকে ‘ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো, আলহামদুলিল্লাহ’ বলে স্ট্যাটাস দিয়ে কিছুক্ষণ রাখেন। তারপর তিনি তার সেই ফেসবুক স্ট্যাটাসটি ডিলিট করে দেন বলে লন্ডন বিএনপির কয়েকজন নেতা দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমকে জানান। এর পরেই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, ইলিয়াস আলী কি এখন তাহলে লন্ডনে অবস্থান করছেন? হারিছ চৌধুরীর মত নাম-ধাম বদলে লন্ডনে বসবাস করছেন তিনি?
লন্ডন তথা যুক্তরাজ্য ইলিয়াসের জন্য অপরিচিত কোনো জায়গা নয়। এর আগেও বহুদিন তিনি সেখানে ছিলেন। এমনকি মিল্টন কিন্স শহরে একটি রেস্তোরাঁয় এক ওয়েটারকে খুনের হুমকি দিয়ে পুলিশি ঝামেলাতেও জড়িয়েছিলেন তিনি।
ইলিয়াস গুম হয়েছেন দাবি করলেও বিএনপি কখনই বলেনি, ইলিয়াস মারা গেছেন। কারণ, তিনি মারা গেছেন- এমন কোনো নিশ্চিত তথ্য মেলেনি। তাই বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীর নাম-ধাম-চেহারা পরিবর্তন করার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ইলিয়াসের বিষয়েও এমন সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে।
দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিগত কয়েক বছরে অন্তত ২০/৩০ বছর ধরে পালিয়ে থাকা জঙ্গি, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী, খুনিদেরকে জসসম্মুখে হাজির করেছে। এমন অন্তত ২০টি ঘটনা গত ২ বছরে দেখা গেছে গণমাধ্যমের পাতায়। তাই ইলিয়াস আলীল অন্তর্ধান রহস্যও উন্মোচিত হবে- এমনটাই আশাবাদ সচেতন মহলের। তবে সত্যিই যদি এমনটা ঘটে, তখন ‘এই ইলিয়াস সেই ইলিয়াস নয়’ বলে বিএনপি অস্বীকার করবে কি না- সেটাই দেখার বিষয়।