
বাংলাদেশে একটি বহুল প্রচলিত মিথ হলো, যুদ্ধাপরাধীদের বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করেছিলো। এটি একটি ডাহা মিথ্যে কথা। বরং আসল সত্য হলো, জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর দালাল আইন বাতিল করে বিচারের পথ রুদ্ধ করে তাদের বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করে।
বঙ্গবন্ধু সবসময়ই যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচারের পক্ষে কথা বলেছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন- একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।
১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে দালাল আইনের আওতায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত দালালদের গ্রেপ্তার শুরু হয়, বিচার কার্যক্রম শুরু হয় এপ্রিলে। দ্রুত বিচারের জন্য সরকার সারা দেশে সর্বমোট ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।
এই বিচারকার্যে ৩৭,৪৪১ জনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। বিপুল পরিমাণ মানুষ অভিযুক্ত হয়ে পড়ায় ও ব্যাক্তিগত শত্রুতার জের ধরে অভিযুক্তের তালিকায় অনেক নিরীহ মানুষের নাম থাকায় ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর ‘বঙ্গবন্ধু সরকার’ একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করে। এই সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে যাদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই’ এমন ২৬,৪৪১ জনকে ক্ষমা করা হয়।
‘তৎকালীন প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বর্ণনা অনুযায়ী-
– দালাল আইনে মোট অভিযুক্ত ব্যাক্তির সংখ্যা- ৩৭,৪৪১ জন।
– সাধারণ ক্ষমা পাওয়া ব্যাক্তির সংখ্যা- ২৬,৪৪১ জন (এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি)
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাক্তির সংখ্যা- ১১,০০০ জন (এদের মুক্তি দেয়া হয়নি)
চুড়ান্ত অভিযুক্ত ১১,০০০ জনের মধ্যে ২,৮৪৮ জনের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়’
রায় প্রাপ্তদের মাঝে ১৯ জনকে মৃত্যুদন্ড, ৩০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৪৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় এবং বাকিরা নানা মেয়াদে কারাদন্ডের সাজা পায়। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু সরকার যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, এমন ১১,০০০ জন অভিযুক্ত ও দন্ডপ্রাপ্ত কাউকেই ক্ষমা করেননি; এদের বিচারকার্য ও দন্ডপ্রদান ঠিকভাবেই চলেছে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর এসব কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য স্থগিত করা সহ তাদের পুর্নবাসন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর, পাকিস্তানি ‘জিয়া সরকার’ পুতুল রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের মাধ্যমে দালাল আইন বাতিলকরণ অধ্যাদেশ জারি করে। ফলশ্রুতিতে, জিয়াউর রহমানের সরাসরি নির্দেশে দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দন্ডপ্রাপ্ত সব মিলিয়ে সর্বমোট ১১,০০০ জন যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দেয়া হয়।
দেশ স্বাধীন হবার পর ‘বঙ্গবন্ধু সরকারের’ উদ্যোগে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশনে চলা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতায় বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তীতে দীর্ঘ তিনদশক পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার’ উদ্যোগে ২০০৯ সালে পুনরায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যা বর্তমানেও চলমান।
সুতরাং এটি স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করেননি, যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা ও পুর্নবাসন করেছিল জিয়াউর রহমান।