জিয়া

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে বর্বরভাবে হত্যার পর দেশের ক্ষমতা দখল করে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর খুনি এবং মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সহায়তায় ১৯৮১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাখে। নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সামরিক ও বেসমামরিক, উভয় পর্যায়েই ব্যাপক নীল নকশা করে সে। ফলে ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায় আপামর জনতার অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন।

বৃটিশ ও পাকিস্তানি শাসকদের স্টাইলেই আবারো মুষ্ঠিমেয় একটা শ্রেণির হাতেই জিম্মি হয়ে পড়ে আপামর জনতা। দেশপ্রমিক সেনাসদস্যদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে সেনানিবাসগুলো। কোণঠাসা হতে থাকে জীবন বাজি ধরে রণাঙ্গণে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা। ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সামাজিক দুর্বৃত্তরা।

রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরেই দেশজুড়ে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে গ্রাম পরিষদ গঠন করে খুনি জিয়া। গ্রামের সাধারণ সরলপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয় এর মাধ্যমে। প্রতিটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে, শুধু নিজেদের পছন্দ মতো গ্রামে গ্রামে ১৫০ জনের একটি করে বাহিনী গঠন ও গ্রাম পরিষদের ১১ জন সদস্যকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামকে জিম্মি করে ফেলে বিএনপি।

এরপর সেই গ্রাম সভার সদস্যদের হাতে তুলে দেওয়া হয় রেডিও। যাতে তারা জিয়াউর রহমানের যেকোনো নির্দেশ সরাসরি বেতারের মাধ্যমে আদিষ্ট হয় এবং সেই অনুসারে পুরো গ্রামের মানুষকে নির্দেশ করে। মূলত এই বাহিনীকে পুরো গ্রামের সাধারণ মানুষের মতামতকে দাবিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো।জিয়া

এমনকি সামরিক ক্ষেত্রেও মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের কৌশলে দাবিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় জিয়া। পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তাদের কাছে টেনে নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের বিভিন্ন অজুহাতে চাকরিচ্যুত ও প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে হত্যা করে সে।

১৯৮৪ সালে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা জর্নালে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ সিরাজুল ইসলামের সেই গবেষণার তথ্য অনুসারে- ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন কমপক্ষে ৫০ জন। তাদের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি ১৯৮০ সাল নাগাদ মুক্তিযুদ্ধের ৮ জন সেক্টর কমান্ডারের মধ্যে মাত্র ২ জনকে আর্মির চাকরিতে বহাল রাখা হয়। তাদের মধ্যে জেনারেল শওকত আলীকে কমান্ড থেকে অপসারণ করে ঢাকার স্টাফ কলেজের প্রিন্সিপাল পদে এবং জেনারেল মঞ্জুরকে ঢাকা থেকে দূরে দুর্গম এলাকা চট্টগ্রামে পোস্টিং দেওয়া হয়।

এছাড়াও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রভাব কমানোর জন্য, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত, ব্যাপক নতুন নিয়োগের ব্যবস্থা করে জিয়া। তবে এসব নিয়োগের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধা সেনার পরিমাণ মাত্র ১৫ শতাংশে নেমে আসে।

আরও পড়ুনঃ গ্রামের মানুষের সাথে প্রতারণা: বিএনপির পুরনো অভ্যাসের দলিল

শুধু তাই নয়, ১৯৭৯ সালে লোকদেখানো নির্বাচনের আগে নিজে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান থাকা অবস্থাতেই বিএনপি নামক একটি দলের নাম ঘোষণা করে জিয়াউর রহমান। উগ্র ধর্মবাদী ও উগ্র বামদের থেকে নেতাকর্মী ধার নিয়ে গঠিত হয় বিএনপি। বিএনপির ১৭০ সদস্যের সেই নির্বাহী কমিটিতে জায়গা হয় ৫৭ জন ব্যবসায়ীসহ ৬৪ জন পেশাজীবীর। রাজনীতিবিদদের বানানো হয় সংখ্যালঘু। এমনকি সেই জালিয়াতির নির্বাচনের পর দেখা যায়, বিএনপির ২০৬ সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৮৪ জনই ব্যবসায়ী। দেশের ভোটের ইতিহাস কলঙ্কিত করতে অবৈধ অর্থ, অস্ত্র ও ভোট কেনার অপচর্চা শুরু হয় জিয়াউর রহমান ও বিএনপির হাত ধরেই। দলটি শুরু থেকেই জনগণ নয় বরং অর্থ ও পেশীশক্তির ওপর ভর করেই দাঁড়াতে চেয়েছে। জিয়ার নেতৃত্বে হত্যাকান্ড

অবশ্য, বন্দুকের নল ব্যবহার করে এই দল প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পরেই- বিএনপির- পতনের বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছিল তৎকালীর পত্রিকা দ্য নিউ নেশন। সেখানে বলা হয়- বিএনপি আসলে কোনো রাজনৈতিক দল নয়। বরং অনেকগুলো উগ্র, বিচ্ছিন্ন ও স্বর্থান্বেষী গ্রুপের একটি সন্নিবেশ এটি। সৃষ্টির শুরু থেকেই সংঘাত-উস্কানির মাধ্যমে এই দল পরিচালিত হয়েছে। কারণ এদের মূল টার্গেট সবসময় মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করা। এছাড়া এদের নিজস্ব কোনো আদর্শ বা ভিত্তি নেই।

আরও পড়ুনঃ প্রতিষ্ঠার পরেই বিএনপির পতনের ব্যাপারে কি ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছিলো

বিএনপি সম্পর্কে সেসময় আরো বলা হয়- সম্ভবত বিএনপি নিজেই নিজের ধ্বংসের কারণ হবে একদিন। এই দলের সদস্যদের অধিকাংশই সীমাহীন লোভ, দুর্নীতি এবং সুবিধাবাদি গোষ্ঠীর। এরা একদিন নিজেদের পাতা ফাঁদে পড়ে নিজেরাই শেষ হয়ে যাবে।

প্রকৃত অর্থে সেই ভবিষ্যতবাণী আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। জিয়া পরিবারের দুর্নীতি, দেশবিরোধী কার্যক্রম, জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততা এবং এই দলের লোকদের নাশকতা ও বিধ্বংসী কার্যক্রমের কারণে দলটি আজ জনবিচ্ছিন্ন। একারণে তারা এখন নির্বাচনে আসতেও ভয় পায়। বিভিন্ন উপায়ে নির্বাচন বানচাল করে, সাম্প্রদায়িকতার উস্কানিতে সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে, পেট্টোল-বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে- রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করে এই রাজনৈতিক দলের ছদ্মবেশে থাকা বিএনপি নামের এই বণিক সমিতি।