
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে বর্বরভাবে হত্যার পর দেশের ক্ষমতা দখল করে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। এরপর দেশের উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয় সে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতে শুরু হয় পেশীশক্তির মহড়া। এমনকি দেশজুড়ে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে গঠন করা গ্রাম পরিষদ। গ্রামের উন্নয়ণের ছদ্মবেশে সাধারণ সরলপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া হয় এর মাধ্যমে। পাকিস্তানি স্বৈরাচার আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর কালো মডেল অনুসরণ করে এই উদ্যোগ নেয় জিয়াউর রহমান।
এই গ্রাম পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রে দেশের ৮৬ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে একজন ব্যক্তিকে গ্রাম-প্রধানসহ মোট ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়। বলা হয়, তারাই গ্রামের যাবতীয় ভালো-মন্দ দেখাশোনা করার বৈধ কর্তৃপক্ষ। ধোঁকাটা এখানেই। গ্রামের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করবে তারা, তবে তাদের এই স্বীকৃতি কিন্তু গণতান্ত্রিক মতামত বা গ্রামের মানুষদের ভোটের ভিত্তিতে নয়। বরং জিয়াউর রহমানের সমর্থক ও অনুগত একটা শ্রেণিকে নিয়ে এটি তৈরি করা হয়, যাদের বানানো হয় গ্রাম সভার সদস্য। আর এই মুষ্ঠিমেয় সদস্যদের বৈঠকের ভিত্তিতেই গঠিত হয় গ্রাম সরকার।
এমনকি এই গ্রাম সভার বৈঠক ডাকার এখতিয়ার দেওয়া হয় থানা সার্কেল অফিসারকে, যিনি একজন সরকারি কর্মচারী। ফলে দেখা যায়, বিএনপি নেতাদের পছন্দের তালিকা অনুসারে দেশের প্রতিটি গ্রামে ১৫০ জন ব্যক্তিকে নিয়ে গঠন করা হয় গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। মূলত এই বাহিনীকে পুরো গ্রামের সাধারণ মানুষের মতামতকে দাবিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো।
প্রতিটি গ্রামের হাজার হাজার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে, শুধু পছন্দের ১৫০ জনের বাহিনী ও গ্রাম পরিষদের ১১ জন সদস্যের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামকে জিম্মি করে ফেলে বিএনপি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শান্তিকমিটি স্টাইলে গঠন করা হয় এসব কমিটি। এরপর সেই সদস্যদের নিয়মিত সুবিধা হিসেবে দেওয়া হয় রেডিও ও পত্রিকা। যাতে তারা জিয়াউর রহমান তথা বিএনপি তথা স্বৈরাচার সরকারের যেকোনো নির্দেশ সরাসরি বেতারের মাধ্যমে আদিষ্ট হয় এবং সেই অনুসারে পুরো গ্রামের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যেখানে গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে অর্থনৈতিক ও মানবিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়া উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে জিয়াউর রহমানের এই উদ্যোগে। ফলে বৃটিশ ও পাকিস্তানি শাসনের স্টাইলেই আবারো মুষ্ঠিমেয় কয়েক ব্যক্তির হাতেই জিম্মি হয়ে পড়ে আপামর জনতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৈয়দ সিরাজুল ইসলামের অ্যাকাডেমিক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘জিয়ার শাসনামল’ শিরোনামে গবেষণাটি ১৯৮৪ সালে পরিচালনা করা হয়।