বিএনপি

গত ৫ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লবিংয়ের জন্য বিএনপি-জামায়াতের টাকা দেওয়ার প্রমাণ আছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি সেই লবিং ফার্মকে দেওয়া অর্থের নথিপত্র হাতে নিয়ে তিনি বলেন, মাসিক ৫০ হাজার ডলারের বিনিময়ে এবং এটি ৩ বছর অব্যাহত ছিল। বছরে ৬ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে। ৩ বছরে প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার হয়। এ ধরনের ১০টি ডকুমেন্ট আমার কাছে আছে।

বিশদ অনুসন্ধানে প্রতিমন্ত্রীর উল্লেখ করা বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রমাণ মেলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে তদবিরের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবেচেয় বড় লবিং ফার্মটিকে ভাড়া করেছিল বিএনপি। দলটির হয়ে এই চুক্তি করেন ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান। যিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত (পরে প্রমাণিত এবং সাজাপ্রাপ্ত) আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন। যদিও বিএনপি সে সময় দাবি করেছিল, এ বিষয়ে তাদের কোনো কিছুই জানা নেই। টবি ক্যাডম্যান

একিন গাম্প স্ট্রস হাউয়ার এন্ড ফেল্ড এলএলপি- একনামে পরিচিত বিশ্বব্যাপী। ২০১৪ সালে প্রায় ৩৬ মিলিয়ন ডলার আয় করে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় লবিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে তারা। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে ১ হাজারেরও বেশি আইনজীবী এবং বিভিন্ন বিষয়ে পেশাদার লোকজন কর্মরত আছেন। তাদের সেই চুক্তিপত্রে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ, কর্ম পরিধি এবং সাফল্যের বিষয়গুলো তুলে ধরে বলা হয় মার্কিন কংগ্রেসম্যান এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সর্বস্তরে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তারা সম্পর্কগুলো কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন কার্যোদ্ধার করতে সক্ষম।

মার্কিন সরকারি ও বিরোধী দল, বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী, রাজনীতি, অর্থনীতি, নীতি-নির্ধারনী পর্যায়সহ সর্বক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব লোকজন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় সেই চুক্তিপত্রটির পরিচিতি অংশে। সেখানে বলা হয়, তাদের হয়ে কাজ করা অংশীদারদের মধ্যে সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করা লোকজন রয়েছেন। ফলে তাদের পক্ষে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী দেশে কাজ করতে কোনো ধরণের সমস্যায় পড়তে হয় না।

ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের মূল কার্যালয় এবং বিশ্বের ২১টি দেশে রয়েছে শাখা। ২০১৫ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে তারা নতুন একটি লবিংয়ের চুক্তি করে। চুক্তিটি হয় ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি’র সাথে। ঠিকানা- ২৮, ভিআইপি রোড, নয়াপল্টন, ঢাকা। বিএনপির পক্ষে একিন গাম্পের সাথে চুক্তিটি করেন ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান।

তবে টবি ক্যাডম্যানের সাথে সে সময় যোগাযোগ করা হলে তিনি পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, যে প্রক্রিয়ার সাথে তিনি যুক্ত নন, সে বিষয়টি সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে চান না। তিনি আরো দাবি করেন, বিএনপির সাথে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

[বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত : মার্কিন সংস্থাকে বিএনপির বিপুল অর্থায়নের নথিপত্র ফাঁস]

চুক্তিতে টবি ক্যাডম্যানের নাম থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি অস্বীকার করলেন, এটি একটা রহস্য বটে। তাই আসল খবর জানতে যোগাযোগ করা হয় সরাসরি একিন গাম্পের সাথে। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র বেঞ্জামিন হ্যারিস (ডিরেক্টর অব কমিউনিকেশন, একিন গাম্প) জবাব দেন, নথিতে যা আছে, তা-ই সত্যি। এর বাইরে ক্লায়েন্টের সাথে যেসব বিষয়ে কাজ করছি আমরা, তা বলা যাবে না। বিএনপির হয়ে টবি ক্যাডম্যানই একিন গাম্পকে এ কাজের জন্য দায়িত্ব প্রদান করেছে কি না- এটা জানতে চাওয়া হলে বেঞ্জামিন জানান, হ্যাঁ, এটা সঠিক।

এরপর একিন গাম্পের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত জবাব এবং নথির বিষয়টি উল্লেখ করে টবি ক্যাডম্যানকে মেইল করা হলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, তিনি এ মুহূর্তে বিএনপির সাথে কাজ করছেন না। আর পূবর্বর্তী সম্পর্কের বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না। কারণ এতে ক্লায়েন্টের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে।

এই টবি ক্যাডম্যান ২০১০ সাল থেকে মতিউর রহমান নিজামী, গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিএনপি-জামায়াত নেতাদের হয়ে বিশ্বব্যাপী ওকালতি করেছেন। বিএনপি জামায়াতের সাথে তার সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালালে দেখা যায়, তিনি বিএনপি নেতা যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন। গোলাম আযম

এ প্রসঙ্গটি তুলে ধরলে টবি ক্যাডম্যান বলেন, অনেক আগেই সাকা চৌধুরীর পরিবার তাকে তাদের আইনজীবী দলকে আইনি পরামর্শ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। আমি তা দিয়েছি। আর জাতিসংঘে তার মামলার বিষয়ে কাগজপত্র ও আবেদন জমা দিয়েছিলাম।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, বিএনপির হয়ে লবিংয়ের জন্য টবি ক্যাডম্যানের সাথে ৪ পৃষ্ঠার একটি চুক্তি সই হয় একিন গাম্পের। আর লবিং ফার্মটির পক্ষে মার্ক হ্যামারসন চুক্তিপত্রে সই করেন। হ্যামারসন হলে একিন গাম্পের দুবাই ও লন্ডনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, একিন গাম্প বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মার্কিন নীতি নির্ধারক, সুশীল সমাজ ও বিএনপি নেতাদের সাথে বৈঠক করিয়ে দেবেন। আর সেইসাথে লবিং করবেন যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিচারের আওতা থেকে বাঁচানোর জন্য।

এসব কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে মাসে ৪০ হাজার মার্কিন ডলার করে ৩ মাসের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার অগ্রিম দেওয়ার বিষয়টি চুক্তির শর্তে উল্লেখ করা হয়। আর কাজের ধরন বুঝে এই পারিশ্রমিকের পরিমাণ দ্বিগুণ বা কয়েকগুণ হতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের কাছে। যিনি যুদ্ধাপরাধী বিএনপি এবং জামায়াত নেতাদের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন। সাকা চৌধুরীকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্থান থেকে ভুয়া দলিল বানিয়ে আনার পর আদালতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে বিচারপতি তাকে তিরস্কৃত করেন সে সময়। এই আইনজীবী লবিংয়ের কার্যক্রমের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, টবি ক্যাডম্যান তো বিএনপির কেউ না। তিনি মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করেন। পার্টির পক্ষ থেকে কিছু করছেন কি না বলতে পারব না। আর লবিংয়ের বিষয়টি অন্যায় কিছু না।

আরও পড়ুনঃ ফরেন এজেন্টদের দিয়ে চক্রান্ত চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত

এ বিষয়ে বিএনপির আর কোনো নেতা কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

সেই বিএনপির একজন এমপি হারুনুর রশিদ সংসদে দাঁড়িয়ে পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে সত্য কথা ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার দাবি জানান। তাকে যথাযথ জবাবই দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। বলেন, পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি (হারুন) বলেছেন, জানা সত্ত্বেও মিথ্যাকে গোপন করিও না। আমি দাবি করবো এই বক্তব্যটি তার রাজনৈতিক জীবনে পালন করছেন কি না তা প্রমাণ করে দেখাবেন। নিজেকে সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে যদি দাবি করেন তাহলে সেই মিথ্যাগুলো যেন গোপন না করেন। অন্ততপক্ষে ভবিষ্যতে এবং এই সংসদে ২০২২ সালের শীতকালীন অধিবেশনে তার দলের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের কুকর্মগুলো যেন প্রকাশ করেন।

সংসদে মার্কিন লবিং ফার্মের সাথে বিএনপির চুক্তির নথি দেখিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে তাদের হিসাব প্রকাশ করে। বিএনপিকে জিজ্ঞেস করতে হবে, এই টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে গেছে কি না? তা না হলে এতিমের টাকা মেরে খেয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। সেই টাকার ব্যবহার এখানে করা হয়েছে কি না, আমরা সেই তদন্ত চাই। পৃথিবীর যত শক্তিধর রাষ্ট্রই হোক না কেন, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ক্ষমতা রাখে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। আমাদের সমস্যা যদি থাকে আমরা এই পার্লামেন্টে আলোচনা করবো। রাজপথে যাবো। আমরা সেখানে সেটার সমাধান করবো।

আরও পড়ুনঃ