
করোনার শুরু থেকে টিকা নিয়ে বিভিন্ন রকম নাটক করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সরকার জনগণকে টিকা আগে দিতে চাইলে ফখরুল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন সরকার জানগণের ওপর টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে চায়।
আবার যখন সরকার সিদ্ধান্ত বদলে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে টিকা দিতে চাইল, তখন ফখরুল ভোল বদলে বলেছেন জনগণ টিকা পাবে না, আগেই সরকার নিজেদের দলের লোকদের দিয়ে দিচ্ছে।
তবে সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের তালিকায় থেকে মির্জা ফখরুলেরও টিকা দেওয়ার সুযোগ চলে এলো অন্য অনেকের আগে। সে সময় তিনি টিকা নেবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। তবে প্রাণ বাঁচাতে সস্ত্রীক নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে সিঙ্গাপুরে গিয়ে সেখান থেকে টিকা নেওয়ার চেষ্টা চালান।
কিন্তু সিঙ্গাপুরে ওই সময় নিজ দেশি নিবন্ধিত নাগরিক ছাড়া অন্য কাউকে টিকা দেওয়া হচ্ছে না- এটা জানতে পেরে ফিরে এলেন দেশে। তারপর এক সকালবেলা দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে না নিয়েই গোপনে টিকাকেন্দ্রে যান এবং সংবাদকর্মীদের কাছে ধরা পড়ে যান।
এভাবে তিনি বহু নাটকের পর দুই ডোজ টিকা তো নিলেনই, সাথে বুস্টার ডোজ পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছেন। নিজে ঠিকমত টিকা নিলেও জনসম্মুখে সরকারের সমালোচনা করে বলেন, দেশের মানুষ এখনও টিকা নিতে পারছে না… ইত্যাদি।
এরইমধ্যে বিএনপির প্রেস উইং থেকে ঢালাওভাবে প্রচার করা হয়েছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি তার নিজ বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন। কিন্তু বিএনপির অনেকেই এই সময় তার করোনা আক্রান্তের বিষয়টি নিয়ে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
আরো পড়ুনঃ ফখরুলে সন্তুষ্ট নন তারেক, চাই নতুন সেবাদাস
বিএনপিপন্থী সংগঠন ড্যাব এর চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন, তিনি করোনা পরীক্ষা করেছেন এবং পজেটিভ রেজাল্ট আসার পরই তিনি এবং তার স্ত্রী আইসোলেশনে গেছেন। একজন চিকিৎসক জানান, প্রথমে তার স্ত্রী রাহাত আরার করোনা পজেটিভ আসে। এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর করোনা পরীক্ষা করেন এবং তারও পজেটিভ আসে।
ফলাফল দেখার পরই তিনি সব কর্মসূচি থেকে নিজেকে গুটিয়ে বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন। কিন্তু বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এই সময় তার করোনা আক্রান্তের বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছেন।
তারা বলছেন, যখন সরকার করোনার কারণে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে আর বিএনপি সব বাধা ডিঙিয়ে কর্মসূচি বেগবান করার চিন্তা-ভাবনা করছে, সেই সময় মির্জা ফখরুলের করোনার আক্রান্ত হওয়াটা রহস্যজনক। আর বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরেও তিনি কীভাবে করোনা আক্রান্ত হলেন, এই প্রশ্ন তাদের।
আরো পড়ুনঃ খালেদার জন্য ‘সময় নেই’ ফখরুলের
তার এভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পেছনে অন্য কোনো ‘কাহিনি’ থাকতে পারে বলেও বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা মনে করছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির তৃণমূল পর্যাযের নেতা-কর্মীদের কাছে কখনই ভরসার প্রতীক ছিলেন না। বিশেষ করে কর্মীদের মনে তার ব্যাপারে অনেক সংশয় এবং অবিশ্বাস রয়েছে। বিশেষতঃ ২০১৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকেই বিএনপির কট্টর সমর্থকরা ফখরুলের সঙ্গে সরকারের গোপন যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি করে আসছেন।
তৃণমূল পর্যায়ের অনেক কর্মী মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে আরেকবার ক্ষমতায় রাখার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই ২০১৮ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল। এমনভাবে প্রার্থী বাছাই করা হয়েছিল, যেন নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হয়। ঐ নির্বাচনে হারের পেছনে মির্জা ফখরুলের সিদ্ধান্তগুলোকেও দায়ী করেন কেউ কেউ।
বিশেষ করে বিএনপির কয়েকজন বিজয়ী প্রার্থীর সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তে কর্মীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। মির্জা ফখরুলের দাবি ছিল, তারেক রহমানের নির্দেশেই এটি করা হয়েছে। তবুও কর্মীরা মনে করেন, তারেক রহমান বিদেশে থাকেন, এমন নির্দেশনা দিলেও তাকে বাস্তবতা এবং কর্মীদের মনোভাবটা বোঝানোর দায়িত্ব ছিল মহাসচিবের।
[ফখরুলের আদৌ করোনা হয়েছে নাকি নাটক, সন্দেহ বিএনপির]
এর পর থেকেই মির্জা ফখরুলের ওপর থেকে বিএনপির কর্মীদের বিশ্বাস টলে গেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন সময়ে তার চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার বহন করেছে- এমন গুঞ্জনের প্রেক্ষিতে তিনি রীতিমতো বিএনপিতে একজন ভিলেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দায়েরকৃত রাজনৈতিক মামলাগুলো কেন নিষ্ক্রিয়- এটা নিয়েও অনেকের মনে সন্দেহ।
খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে না যাওয়া, পুনরায় মহাসচিব হওয়ার ইচ্ছায় দলীয় কর্মসূচিতে নিজের পক্ষের লোকজনকে ফ্রন্টলাইনে রেখে অন্য নেতাদের আস্থাভাজন কর্মীদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে লন্ডনে বার্তা দেওয়া- তিনিই সব কর্মসূচিতে এক সব কিছু করে দল টিকিয়ে রেখেছেন, বাকিরা কোনো কম্মের নয়। প্রতিটি সমাবেশে গ্রুপিং, কোন্দল, মারামারি, মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনাগুলোর পেছনেও তাকে দায়ি করছেন ঢাকা মহানগরের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা।
বিএনপি গত নভেম্বর থেকে ধাপে ধাপে আন্দোলন বেগবান করার চেষ্টা করছে এবং এসব কর্মসূচির কারণে ঝিমিয়ে পড়া নেতা-কর্মীদের মধ্যে কিছুটা হলেও চাঞ্চল্য এসেছে, ঠিক সেই সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলে গেলেন আইসোলেশনে!
আরো পড়ুনঃ ফখরুল-রিজভীদের অপপ্রচারের হীন প্রচেষ্টার বলি খালেদা জিয়া ও বিএনপি
বিএনপির প্রধান তিন নেতার মধ্যে খালেদা জিয়া বহুদিন ধরেই নিষ্ক্রিয়। তারেক রহমান পালিয়ে আছেন লন্ডনে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি প্রত্যক্ষভাবে ওয়াকেবহাল নন। কাজেই মির্জা ফখরুলই হলেন দলের সর্বেসর্বা। সেই অবস্থানে থেকে তিনি যখন রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে গুটিয়ে আইসোলেশনে ঢুকে পড়েন, তখন দলের সাংগঠনিক তৎপরতা যে বিঘ্নিত হবে এটা বলাই বাহুল্য।
গতকাল বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী করোনা নিয়ে সরকারের বিধি-নিষেধের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি তার চিরাচরিত স্টাইলে উদ্ভট দাবি করেছেন, সরকার হয়তো বিএনপির কর্মসূচিকে দমানোর জন্যই এ ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে।
যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের বক্তব্যকে উদ্ভট এবং হাস্যকর বলে মন্তব্য করেছেন। তারা বলেছেন, করোনার প্রকোপ বাড়ছে, এতে কোনো রাজনীতি নেই এবং এমন পরিস্থিতিতে বিধি-নিষেধ আরোপ যুক্তিসঙ্গত।
কিন্তু রিজভীর এমন হঠকারী বক্তব্য এবং মির্জা ফখরুলের অসুস্থতার মধ্যে যোগসাজশ দেখছেন বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা। তারা মনে করছেন, ফখরুল কি তাহলে আবার সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে করোনা নাটক সাজালেন?