
গত ক’দিন ধরেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভাঙা রেকর্ডে নতুন গান বাজিয়ে যাচ্ছেন- খালেদা জিয়া দেশের ‘প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা’ আর তার পুত্র তারেক রহমান ‘শিশু মুক্তিযোদ্ধা’। সেই সাথে খালেদা জিয়া নাকি তারেক ও তার ছোটভাই কোকোর হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন!
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকারী এমন ভয়াবহ মিথ্যাচার ও বিকৃত তথ্য দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে। যার ফলে বিএনপি এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মত রাজনীতি বিশ্লেষকদের।
মির্জা ফখরুলের এমন মন্তব্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যেমন বিকৃত করছে, তেমনি এসব মন্তব্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অপমানের শামিল বলে জানিয়েছেন খোদ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরেও থেমে যাননি রাজাকার তালিকার ৭১০নং-এ থাকা রুহুল আমিন চখার পুত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি একই বক্তব্য গতকালও দিয়েছেন। দলের চেয়ারপারসনকে এমন নতুন খেতাব দেওয়ার পর বিএনপি কী ভাবছে, তা নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তর টিভিতে আমন্ত্রণ জানানো হয় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনকে।
ব্যারিস্টার খোকনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, মির্জা ফখরুলের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিত কী? কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি খালেদা জিয়াকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করলেন?
প্রশ্নের জবাবে অস্বস্তিতে ভুগতে দেখা যায় বাকপটু ব্যারিস্টার খোকনকে। তিনি উপস্থিত অপর আলোচকদের সামনে একেবারে অপ্রতিভ হয়ে পড়েন। তবুও উপস্থাপকের প্রশ্নের মুখে এবং প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনসহ অন্যদের উপস্থিতিতে নিজেকে রক্ষা করে এর জবাব দিতে বাধ্য হন।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, মির্জা ফখরুল সাহেব এমন তথ্য কোন সেন্সে বলেছেন, আমি ঠিক জানি না। খালেদা জিয়ার স্বামী একজন সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। স্বামী রণাঙ্গনে ছিলেন বলে গৃহবধূ খালেদা জিয়া অনেক কষ্টে ছিলেন, সেই সেন্সে বলেছেন হয়ত।
বিএনপি নেতার কথা শেষ হওয়ার আগেই উপস্থাপক বেমক্কা প্রশ্ন করে বসেন, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের সকল সেক্টর কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানেরাও একই যুক্তিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। তাই না?
তখন ব্যারিস্টার খোকন আমতা আমতা করে মুখে একটু কাষ্ঠহাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, খালেদা জিয়া যদি মুক্তিযোদ্ধা হতেন, তবে তো সনদ বা ভাতা পেতেন। যেহেতু পাননি, তাহলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। আর ফখরুল সাহেব আসলে ওইভাবে মিন করে কথাগুলো বলেননি, জাস্ট কথার কথা হিসেবে বলেছেন হয়ত।
উপস্থাপক তখন এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের মন্তব্য জানতে চান। তখন কামাল হোসেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম এর লেখা একটি বইয়ের রেফারেন্স টেনে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিলেন। রণাঙ্গন থেকে জিয়াউর রহমান একটি চিঠি দেন খালেদা জিয়াকে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে আসার জন্য। কিন্তু খালেদা পাল্টা জবাব দেন তিনি সেখানে ভালো আছেন বলে।
কামাল হোসেন এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াকে লেখা পাকিস্থানি কর্নেল বেগ এর একটি চিঠির রেফারেন্স দিয়ে বলেন, সেই চিঠিতে জিয়ার কাজকর্মে সন্তুষ্ট বেগ লিখেছেন জিয়ার স্ত্রী-পুত্ররা ভালো আছে, চিন্তা না করতে। আর মেজর জলিলের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে।
একইসাথে মির্জা ফখরুল কর্তৃক ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দাবি করা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অগ্রাহ্য করে পাকিস্থানের সেনা কর্মকর্তা জেনারেল জানজুয়ার (যার বাড়িতে ছিলেন খালেদা মুক্তিযুদ্ধের সময়) মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠান। একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটা খোদ পাকিস্থানের নিকটও অপ্রত্যাশিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে শত্রুপক্ষের একজন সেনা কর্মকর্তার প্রতি এমন টান থাকে কীভাবে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ খালেদার? এমন প্রশ্ন রাখেন কামাল হোসেন।
আওয়ামী লীগের নেতার যুক্তির তোড়ে বিব্রত হয়ে পড়েন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার খোকন। কামাল হোসেন আরও বলেন, ফখরুল তার পদ রক্ষায় তারেককেও স্বাধীনতার ঘোষক বলে ফেলতে পারে। বিএনপি যেমন জিয়াকে ঘোষক দাবি করে…। সংবিধান সংবিধান বলে চিৎকার করেন আপনারা, আর সংবিধান মানেন না। সংবিধান মানলে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করতে পারেননা। বিএনপি নিজের মত করে সংবিধান তৈরি করে, সেই সংবিধান মানে আরকি।
এমন উপুর্যপুরি আক্রমণে পর্যুদস্ত বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার খোকন শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন, মির্জা ফখরুল এমন দাবি কেন করেছেন, সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। এর দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ তার নিজের, দলের নয়।